ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কেন হামাসকে নিরস্ত্র করতে চায়? গাজা যুদ্ধের পেছনের আসল কারণ কী? হামাসের জন্ম থেকে বর্তমান সংঘাত পর্যন্ত-কেন বিশ্বশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করতে চায়, কীভাবে এই যুদ্ধ ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে, এবং কে আসলে হারছে সবচেয়ে বেশি -
মধ্যপ্রাচ্যের এক প্রাচীন সংঘাত-যেখানে প্রতিটি ইঞ্চি জমি, প্রতিটি পতাকা, আর প্রতিটি বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত রক্ত, ইতিহাস আর রাজনীতি। আজ আমরা জানব-ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কেন হামাসকে নিরস্ত্র করতে চায়? হামাস, যার পূর্ণরূপ Harakat al-Muqawama al-Islamiyya, অর্থাৎ “ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন”। ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে এক আন্দোলন হিসেবে হামাসের জন্ম হয়। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য-ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান এবং একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু হামাস কেবল রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তাদের একটি সশস্ত্র শাখা আছে-ইজ্জাদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড, যারা নিয়মিতভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রকেট হামলা, সীমান্ত আক্রমণ ও প্রতিরোধ অভিযান চালায়। ইসরায়েলের কাছে হামাস মানে একটাই- “সন্ত্রাস”। ইসরায়েল বলে, হামাস কেবল ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। ইসরায়েল দাবি করে, গাজা উপত্যকা হামাসের হাতে অস্ত্রভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে-যেখানে তারা শত শত কিলোমিটার টানেল বানিয়েছে, রকেট তৈরি করছে, আর ইরানের সহায়তায় সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। তাদের মতে, যতদিন হামাসের হাতে অস্ত্র থাকবে, ততদিন ইসরায়েল নিরাপদ নয়। এবার প্রশ্ন আসে-যুক্তরাষ্ট্র কেন এত সক্রিয়?
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র। ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে হামাস একটি “সন্ত্রাসী সংগঠন- যা শুধু ইসরায়েলের নয়, আমেরিকার কৌশলগত স্বার্থেরও বিরোধী। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি রক্ষা, তেলবাণিজ্য, এবং আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক উন্নয়ন-এসবই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু হামাসের অস্তিত্ব এই পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
তাছাড়া, হামাস ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আর ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের চোখে অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ। তাই হামাসকে নিরস্ত্র করা মানে-ইরানের প্রভাবকে দুর্বল করা। কিন্তু এই সংঘাতের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হলো- গাজার সাধারণ মানুষ। বোমা, অবরোধ, খাদ্য সংকট, ও নিরন্তর ভয়-এই বাস্তবতার মধ্যে তারা বেঁচে আছে বছরের পর বছর। ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়, কিন্তু সেই আগুনে পুড়ে যায় হাজার হাজার নিরীহ জীবন।
ফিলিস্তিনিরা বলে , ইসরায়েল হামাসের নামে গণহত্যা চালাচ্ছে। আর ইসরায়েল বলে, হামাস জনগণকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এই অভিযোগ-প্রত্যঅভিযোগের মধ্যে সত্যি হারিয়ে যায় মানবতা। বিশ্লেষকরা বলেন-এই “নিরস্ত্রীকরণের” মূল উদ্দেশ্য শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ। যদি হামাস দুর্বল হয়, তাহলে গাজায় এমন একটি প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতায় রাজি। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র চায় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক আরও মজবুত হোক। যেমন- সৌদি আরব, মিশর, ও জর্ডান ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এই চিত্রে হামাস এক বড় বাধা। তবে প্রশ্ন হলো-হামাসকে যদি পুরোপুরি নিরস্ত্র করা হয়, তবুও কি সংঘাত শেষ হবে? সম্ভবত না….কারণ, সংঘাতের মূল শেকড় অস্ত্র নয়-অন্যায়, দখল, আর আত্মপরিচয়ের লড়াই।
যতদিন ফিলিস্তিনিরা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে, ততদিন এই আগুন অন্যভাবে জ্বলে উঠবেই। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে নিরস্ত্র করতে চাইছে নিজেদের নিরাপত্তা ও প্রভাব রক্ষার জন্য। কিন্তু গাজার ধ্বংসস্তূপে যে শিশুর কান্না প্রতিধ্বনিত হয়, তা মনে করিয়ে দেয়-এই যুদ্ধের আসল হারানোরা কারা।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন