ইসরায়েল সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছে- ‘গাজা নগরী খালি করতেই হবে।’এই হুঁশিয়ারির পেছনে কী আছে? কেন এতো বড় পদক্ষেপ নিতে চাইছে ইসরায়েল? আর এর ফলে কী হতে পারে লাখ লাখ নিরীহ মানুষের ভাগ্যে?
গাজা, ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ছোট্ট একটি অঞ্চল, কিন্তু আধুনিক
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংঘাত-প্রবণ জায়গাগুলোর একটি। ইসরায়েলি সেনারা বলছে, হামাস যোদ্ধাদের
ঘাঁটি ও সুড়ঙ্গপথ এই শহরের ভেতরেই লুকানো। তাই তাদের দাবি, যদি সাধারণ মানুষ গাজা
খালি না করে, তাহলে অভিযান চালাতে গিয়ে ব্যাপক হতাহতের ঝুঁকি থাকবে।
কিন্তু এখানেই প্রশ্ন- গাজা কি আসলেই খালি করা সম্ভব? প্রায়
২০ লাখ মানুষের বসবাস এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। তাদের জন্য আশ্রয় নেওয়ার মতো নিরাপদ জায়গা
নেই।সীমান্ত বন্ধ, চারপাশে যুদ্ধ, মানুষের চোখে- মুখে শুধু আতঙ্ক।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনী একাধিকবার সতর্ক করেছে- “যারা এখনই দক্ষিণের দিকে চলে যাবে, তারাই নিরাপদ থাকবে। গাজা নগরীর ভেতরে থাকলে জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে।”
এই ঘোষণার পর শহরের ভেতর লাউডস্পিকার, লিফলেট এবং সামাজিক মাধ্যমে
ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বার্তা। এমনকি মোবাইলে এসএমএস দিয়েও মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে।তবে
সাধারণ মানুষের অভিযোগ- “কোথায় যাবো আমরা? চারদিকে তো শুধু ধ্বংসস্তূপ আর অবরোধ!”
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় অর্ধেক মানুষ ইতিমধ্যেই গৃহহীন হয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলো ভরে গেছে আহত রোগীতে। বিদ্যুৎ নেই, খাবার ও পানীয় জলের তীব্র সংকট। বিশেষ করে শিশু ও নারীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে। কেউ কেউ দিনের পর দিন না খেয়ে বেঁচে আছে। তাদের চোখে ভয়, অনিশ্চয়তা আর বেঁচে থাকার লড়াই।
গাজার এই সংকট হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাত চলছে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয় বিরোধ। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে গাজা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে যায়। পরবর্তীতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে এলেও, ২০০৭ সাল থেকে হামাস কার্যত গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন থেকেই ইসরায়েল গাজার উপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে। ফলে বাইরের দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এই ছোট্ট নগরী। ইসরায়েলের এই ঘোষণা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
জাতিসংঘ বলছে- “২০ লাখ মানুষকে এত অল্প সময়ে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব
নয়। ”মানবাধিকার সংগঠনগুলোও একে “অমানবিক এবং বিপজ্জনক” বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানালেও, সাধারণ মানুষকে
নিরাপদ রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
অন্যদিকে, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো একে স্পষ্টভাবে “জাতিগত নিপীড়ন” বলে দাবি করছে।ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ বললেন- “আমি সারা জীবন এখানে কাটিয়েছি। এখন কোথায় যাবো? আমার বাড়িঘর, স্মৃতি সব এখানে। মৃত্যু যদি আসতেই হয়, তাহলে আমি আমার মাটিতেই মরবো।”
একজন মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন- “আমার তিনটি ছোট বাচ্চা আছে। আমি জানি না কোথায় নিয়ে যাবো তাদের। বোমার শব্দে ওরা ঘুমাতে পারে না। আমরা কেবল বেঁচে থাকার প্রার্থনা করছি।” যদি ইসরায়েল তাদের পরিকল্পনা মতো গাজা নগরী পুরোপুরি খালি করিয়ে সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে, ঘরবাড়ি ধ্বংস হবে, এবং মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে।
কিছু বিশ্লেষক বলছেন,- এভাবে গাজাকে জোর করে খালি করানো আসলে ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন অস্থিরতার বীজ বপন করবে। কারণ মানুষ তাদের ঘর হারালে, ক্ষোভ আরও বেড়ে যাবে, সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে।
বিশ্ব নেতারা শান্তির আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই
আহ্বান কতটা কার্যকর? কারণ ইতিহাস বলে, শান্তির উদ্যোগ বহুবার নেওয়া হলেও বাস্তবে সংঘাতই
বেশি বেড়েছে। তবে সাধারণ মানুষের আশা একটাই-
যুদ্ধ নয়, রক্ত নয়, তারা চায় শান্তি।তাদের স্বপ্ন একদিন হয়তো
গাজা আবারও হবে স্বাভাবিক জীবনের নগরী।
ইসরায়েলের হুঁশিয়ারি- গাজা খালি করতেই হবে। কিন্তু বাস্তবে, গাজার মানুষ কি কোথাও পালাতে পারবে? না কি এই হুঁশিয়ারির আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও বড় এক মানবিক বিপর্যয়ের ছায়া? উত্তর সময়ই দেবে।
তবে ইতিহাস জানায়- প্রতিটি যুদ্ধ শেষে জয় হয় না অস্ত্রের, জয় হয় মানবতার।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন